রথযাত্রায় বিদ্যুতায়িত হয়ে বগুড়ায় ৫ জনের মৃত্যু : আহত অন্তত ২০

স্টাফ রিপোর্টার : বিকেল ৫টা। উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হয়েছে রথযাত্রা। হাজারো ভক্ত টানছেন রথের রশি। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবার চোখেমুখে আনন্দের দ্যুতি। শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথ এগোচ্ছে সামনে। মন্দির থেকে ১০০ গজ দূরে যেতেই রথের চূড়া স্পর্শ করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক তার। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় রথে। বিদ্যুতায়িত হন অনেক রথযাত্রী। কান্নার রোল পড়ে যায়। ছোটাছুটি করেন অনেকেই। আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। কিছুক্ষণের মধ্যে খবর আসে হতাহতের। শহরের ইসকন মন্দির থেকে রথযাত্রা বের হওয়ার পর সেউজগাড়ী আমতলা মোড় এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মারা যান পাঁচজন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিহতরা হলেন বগুড়ার সদর উপজেলার তিনমাথা রেলগেটের লঙ্কেশ্বরের স্ত্রী আতসী রানী (৪০), শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল গ্রামের রঞ্জিতা মোহন্ত (৬০), আদমদীঘি উপজেলার কুন্ডু গ্রামের নরেশ মহন্ত (৬০), শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল ইউনিয়নের কুলুপাড়া গ্রামের অলক কুমার সরকার (৪২) ও সারিয়াকান্দি উপজেলার সাহাপাড়ার বাসুদেব সাহার স্ত্রী জলি সাহা ওরফে সবিতা (৩০)। আহতদের মধ্যে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল ও ২৫০ শয্যা মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ৪৩ জন চিকিৎসাধীন। বিদ্যুৎস্পর্শে সৃষ্ট আগুনে অনেকের শরীর ঝলসে গেছে। খবর পেয়ে জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শুভাশীষ পোদ্দার লিটন হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজখবর নেন।

শজিমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ জানান, তাদের হাসপাতালে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে বর্তমানে ৩৮ জন চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে দুজন আইসিইউতে আছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী বগুড়া শহরের চেলোপাড়ার বাসিন্দা বিধান কুমার সিংহ জানান, সেউজগাড়ীর ইসকন মন্দিরের রথযাত্রা শুরুর আগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বগুড়া-৬ আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু, জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। সভা শেষে অতিথিরা রথের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পর চলে যান। এরপর রথ টানার কাজ শুরু হয়। হাজারো ভক্ত দড়ি ধরে একসঙ্গে রথ টানতে শুরু করেন। রথটি পালপাড়ার ইসকন মন্দির থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কে (সাতমাথা-তিনমাথা পুরান বগুড়া) উঠে সাতমাথার দিকে যেতে শুরু করে। সেখান থেকে একশ গজ সামনে সেউজগাড়ী আমতলা বা কালার মোড়ে যাওয়ার পথেই রথের চূড়াটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এলে তাতে আগুন ধরে যায়। এ সময় রথের ওপরে বসে থাকা ও নিচে থাকা অর্ধশত ভক্ত বিদ্যুতায়িত হন। শুরু হয় কান্নার রোল। এরপর ছোটাছুটি। পরে পাঁচজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।

বগুড়া ইসকন মন্দিরের সভাপতি দিলীপ কুমার দেব বলেন, এখন পর্যন্ত তিনজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, আহত যারা আছেন, তাদের ঝুঁকি কেটে গেছে।

বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ বলেন, রথযাত্রার সময় রথের চূড়াটি বিদ্যুতের তারের সংস্পর্শে এলে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজন এবং মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।

বগুড়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শুভাশীষ পোদ্দার লিটন বলেন, এটি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা সাধ্যমতো তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছি। বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। কীভাবে ঘটনাটি ঘটল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সতর্কতা আমলে নেওয়া হয়নি : রথযাত্রায় অংশ নেওয়া স্থানীয় সাংবাদিক অরূপ রতন শীল জানান, রথের গাড়িটি যারা টানছিলেন, তাদের বারবার সড়কের ওপরে থাকা হাইভোল্টেজ তারের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। সড়কের ওপরে আড়াআড়িভাবে টানা তারের নিচ দিয়ে রথের গাড়িটি সাবধানে পার করার জন্য ইসকন বগুড়ার সভাপতি খরজিতা কৃষ্ণ দাস বারবার মাইকে সতর্ক করছিলেন। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তার সতর্কবাণী চাপা পড়ে যায়। তিনি এর আগে একাধিকবার রথযাত্রায় অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে বলেন, ‘রথযাত্রার মতো ধর্মীয় এই উৎসব অনুষ্ঠানে এর আগে এমন প্রাণহানির ঘটনা কখনো ঘটেনি।’

ঘটনার পরপরই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয় : নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) নির্বাহী প্রকৌশলী (১) আব্দুল মান্নাফ জানিয়েছেন, বিকেল সোয়া ৫টার দিকে রথের গাড়িতে বিদ্যুৎস্পর্শের ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। রাত সাড়ে ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের যে তার সড়কের ওপর দিয়ে পারাপার করা হয়েছে, সেগুলোর উচ্চতা ছিল ১০ মিটার। ধারণা করা হচ্ছে, রথের গাড়িতে এমন কোনো উঁচু দণ্ড যুক্ত করা হয়েছিল, যেটি বিদ্যুৎ পরিবাহী। আর সে কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।’

তদন্ত কমিটি গঠন : বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (এডিএম) নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সৎকারের জন্য প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা বা অন্য কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হবে।

Related posts

Leave a Comment